প্রসঙ্গ অনুরুপা দেবীর দেবদাসী গল্প : শিরোনাম : ১ . ' দেবদাসি ' প্রথার অন্ধদিক প্রসঙ্গ । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

 




' দেবদাসী'  প্রথা এক প্রাচীন অসামাজিক এবং অবশ্যই অমানবিক  নিষ্টুর প্রথা । দেখনদারি উদ্দেশ্য দেবতার সন্তোষ্টির জন্য নৃত্যগীত পরিবেশন করবার নিমিত্তে এই কুপ্রথার উদ্ভব । মনোনীত নারীদেরকে এক প্রকার মন্দির বাসে বাধ্য করা হত । দেবতার নামে উৎসর্গিত নারীদের জীবন , আর পাঁচজন  রমণীর থেকে স্বতন্ত্র । তাঁদেরকে বালিকা বয়সেই , অত্যন্ত সুচতুর ভাবে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা রাখবার মধ্য দিয়ে বাকহীন অসহায় সম্প্রদায়ে পরিণত করে রাখত , এই কুপ্রথার নেপথ্যের কুশীলবগণ । অসহায় নারীগণকে সমাজ সংসার থেকে বিচ্ছন্ন করে রাখবার নেপথ্যে একাধিক হেতু বিদ্যমান । আসলে , এই সকল প্রথার উদ্ভব ও রক্ষাকর্তাগণ , প্রথা ভঙ্গের আশঙ্কায় সর্বদায় আতঙ্কিত থাকেন  । কেননা , দুর্বল নিপীড়িত মানুষের উপর পীড়ন করবার আলাদা এক পৈচাশিক  আনন্দ আছে বোধহয়  । সভ্য অসভ্য যেকোন সমাজে , এই ধরনের প্রথা কলঙ্ক স্বরুপ । 

সমাজ থেকে এইসকল নারীগণকে বিচ্ছিন্ন করবার হেতু , মূলত তাঁদেরকে একক সত্ত্বায় পরিণত করা । সকল কুপ্রথার নেপথ্যের মাথা কুশীলবরা ভালো মত জানে ,  একক মানুষের চিৎকার , গণভাবনায় তেমন পরিণত হয় না । দ্বিতীয়ত , এই সকল রমণীকে বাকহীন করে রাখাও একান্ত প্রয়োজন , অন্ততঃ , এই কুপ্রথা রক্ষার স্বার্থে । খুব ছোট থেকেই , তাদের তাই একক সত্ত্বায় পরিণত করবার একটা অনন্য প্রচেষ্টা লক্ষ্যগোচর হয় । তাছাড়া , ঘর কান্না , সংসার বাচ্চার প্রতি গণমানবের এক অবিচ্ছেদ্য টান । জীবনের সুখ আস্বাদের সিংহভাগই থাকে সংসার জীবন গ্রন্থির অন্তরালে । যেহেতু , দেবদাসীগণ দেবতার চরণে উৎসর্গিত , সুতরাং , তাঁদের মানব সংসার করাটা খুব একটা শোভাকর  নয় । তাই  বাচ্চা , সংসার ঘরকান্না তাঁদের ললাটে বরাদ্দ থাকে না । এই সকল রমণীকে সমাজ জীবনে স্বাধীনভাবে চলাচলের অনুমোদন দিলে , তাঁদের হৃদয়ের গলিতে সংসার করবার প্রলোভন জমা হতে পারে । সেই ভয় থেকেই এদেরকে সমাজ সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করবার মত অসামাজিক কর্মকান্ডে বেঁধে ফেলতে চাই , এই প্রথার কুশীলবগণ । 

পার্থিব জীবনের শুরুর লগ্ন হতেই , সমাজ মূলত পুরুষতান্ত্রিক । সমাজিক মানুষ মূলত , দুই রকমের বিভাজনে বিভক্ত - নারী ও পুরুষ । সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় , অনেক ক্ষেত্রেই এক ধরনের পক্ষপাত পুরুষকে সমাজিক অবয়বের মাথায় পরিণত করেছে । তুলনায় , নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছার যথার্থ মূল্যায়ন অনেক সময় হয়নি । এক বা একাধিক কুপ্রথার শিকার হয়েছেন তাঁরা । সতীদাহ প্রথা , কুলীন বিবাহ , বহু বিবাহ , তালাক সহ একাধিক ধর্মীয় প্রথার উৎপীড়নে তাঁদের জীবনের গল্পগুলো মুখরিত হতে পারেনি সেইভাবে  । অন্তঃপুরের প্রাণ হিসাবে তাঁদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে যুগের পর যুগের । তাই সুদীর্ঘকাল তাঁরা অন্তঃপুর নিবাসী হিসাবেই  কোন রকম নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল  । নারীকে  দমন করে রাখবারই একটি নিষ্টুর অসামাজিক প্রথা এই ' দেবদাসী ' প্রথা । মূলত পুরোহিত ও অন্যান্য ক্ষমতাবান পুরুষদের ভন্ডামির নামান্তর । 

নারীকে ভোগসর্বস্ব করে রাখাই  এই প্রথার মুখ্য উদ্দেশ্য । দেবতাকে সন্তুষ্টি নামমাত্র ,  এই নগ্ন প্রথাকে একটি ধর্মীয় বাতাবরণ দেওয়ার মধ্য দিয়ে নেপথ্যের কুদিকগুলো ঢাকবার চেষ্টা করা হয়  । ধর্মীয় নিষ্ঠার সাথে সম্পৃক্ততা স্থাপনই মানুষের ধর্ম , স্রোতের বিপ্রতীপ , অর্থাৎ ধর্মের বিধিবিধানকে অবজ্ঞা করলে ভয়াবহ পাপ হয় । এই ভয়ের গন্ডির অভ্যন্তরেই মানবজীবনের মূল সুতোখানি বাধা । তাই , প্রথা সমূহকে ধর্মীয় রুপ দেওয়ার দরকার হয়ে পরে  । নারীগণকে দেবতার চরণে উৎসর্গিত করা হয় । পুরোহিতগণ যেহেতু দেব প্রতিনিধি , সকল দেবসম্পত্তির উপর তার একচ্ছত্র অপ্রতিরোধ্য অধিকার । তাই দেব সেবিকা , দেবদাসীরা পুরোহিত এবং অন্যান্য ক্ষমতাবান পুরুষগণের রক্ষিতাতে পরিণত হয় । 

সুলেখিকা অনুরুপা দেবী তাঁর' দেবদাসী ' গল্পটিতে এই নগ্ন কুপ্রথার অন্ধদিকটি অপরুপ ভঙ্গিমায় পরিস্ফুটিত করে তুলতে ভীষণ রকম সফল হয়েছেন । গল্পটি বিশোকা , চম্পা সহ অন্যান্য দেবদাসীদের স্বপ্ন এবং আশা ভঙ্গের গল্প । জন্মের পরমুহূর্তই পিঙ্গলেশ্বর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বিশোকাকে দেবদাসী রুপে গ্রহণ করে । প্রধান দেবদাসী চম্পার কাছেই লালিত পালিত হয় বালিকা বিশোকা । আর পাঁচটা সাধারণ বালিকার জীবন থেকে পৃথক স্বতন্ত্র পরিআবহে চালিত হয় তার জীবনের গল্পগুলো । কেননা সে ভবিষ্যৎ দেবদাসী । দেবতার চরণে উৎসর্গিত দেবী । এই দেবীত্বের স্বপ্ন বিশোকার জীবনের মূল অবলম্বন । একেবারে বালিকা বয়সে , তাকে এটা করতে নেই , ওটা করতে ' নেই 'র মধ্যে বেড়ে উঠতে হয়েছে । 
' এ কিছু নতুন কথা নয় । বাল্যবধি চিরদিনই উঠিতে বসিতে বিশোকা শুনিয়া আসিতেছে । ভবিষ্যৎ দেবদাসীকে অনর্থক হাসিতে নাই , দৌড়িয়া চলিতে নাই , আব্দার করিতে নাই । এককথায় তাহার কিছুই করিতে নাই ' 

বিশোকার অষ্টম বছর পূর্ণ হওয়ায় দেবদাসী প্রথার নিয়ম অনুযায়ি , তার পৃথক থাকবার ব্যবস্থা করা হয় । অল্প বয়সে স্বাধীনতার প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য টান থাকে সবার , নতুন ঘর পাওয়ার ঘটনায় তাই আনন্দ হয় বিশোকার  , তবে এই আনন্দ নিমিষেই নিরানন্দে পরিণত হয় , যখন সে শ্রবণ করে , উক্ত ঘরে তাকে  একা শয়ন করতে হবে । প্রবল ভাবেই , বিশোকা পালক মাতা চম্পাকে আলিঙ্গন করবার চেষ্টা । চম্পা দেবদাসী , সমাজ বিচ্ছিন্ন একজন অসহায় নারী ,দেবদাসী প্রথার নিয়ম রীতির প্রতি প্রবল  দায়বদ্ধ । তাই অসহায় , বিশোকার ক্রন্দন তাঁর মাতৃহৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করলেও , সে প্রথার ভাঙবার কথা চিন্তাও করতে পারে না । 
চিত্ত নির্বিকার রাখাই দেবদাসীর কর্তব্য ! সেই কর্তব্যের বিরুদ্ধাচরণ তো আর তিনি করিতে পারেন না । ' 

যথারীতি সময় পূর্ণ হয় । বিশোকাকে দেব চরণে উৎসর্গ করবার অনুষ্টান ঘটা করে  হয় । সমান্য নারীর  দেবীত্বে  উন্নতিকরণ নিঃসন্দেহই গৌরবের । মানবের অনেক উর্দ্ধে দেবতার অবস্থান । সর্বশ্রেণীর মানুষের চোখে তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র । দুষ্টের দমন কর্তা , অসহায়ের আশ্রয় দেবতার অংশ হওয়া বিশোকার জীবনের সেরা মুহূর্ত । 
ক্ষুদ্র মানবী আপনাকে দেবীত্বে অভিসিক্তা করিয়া এক বিপুল গৌরবে নিজেকে বিমন্ডিতা ও আপনার জন্ম সার্থক বোধ করিল । ' 
গল্প এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে । গল্পকার অত্যন্ত মুনশিয়ানার সাথে এই কুপ্রথার নগ্ন দিক সমূহ উন্মোচন করেন পাঠক দরবারে । বিশোকা এখন পূর্ণ যৌবনা । নাটমন্দিরে বিশোকার নাচে আমোদিত হয়ে উত্তরোত্তর দর্শক বাড়ছে , এমনকি স্বয়ং মহারাজ উৎপলাদিত্যও হাজির হলেন একদিন  বিশোকার মজলিশে । অন্যান্যদের মত তিনিও গুণমুগ্ধ হয়ে পড়লেন বিশোকার নৃত্যের । 

অবোধ বিশোকা দেবদাসী এই প্রথার কুদিক সমূহ সম্পর্কে মোটেও ওয়াকিবহাল নয় । দেবতার সন্তোষ্টিই তার জীবনের মূল ব্রত । নৃত্য গীত , সৌন্দর্যময় মুখাবয়বে গুণমুগ্ধ দর্শককুল বিবশ হয়ে করতালি দিলেও , বিশোকা নিরুত্তর । সে দেবী , দেবতার সেবিকা । সাধারণ গণমানবের উচ্ছ্বাসে আহ্লাদ করা তার সাজে না । সে বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক নয়নে । তবে , মহারাজ উৎপলাদিত্য , এই কুপ্রথার অন্ধদিক সমূহ সম্পর্কে ভীষণরকম ওয়াকিবহাল । তিনি বিশোকার গুণমুগ্ধ কিম্বা তারও হয়তো অধিক । নিষ্পাপ বিশোকা এই অমানবিক প্রথার অন্ধগলিতে হারিয়ে যাক সেটা তিনি চাননি । তাঁকে সতর্ক করা নিজের কর্তব্য মনে করলেন । গোপনে বিশোকার সাথে সক্ষাৎ করেন এবং  বললেন , 
 ' যদি এমনই পবিত্র নির্মল থাকিতে চাও , তবে অবিলম্বে এ স্থান ত্যাগ করো । ' 
বিশ্বাস অবিশ্বাসের এক প্রবল দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয় বিশোকা । 
' বিশোকা এখনও কিছু বুঝিল না , কিন্তু অজানা বিপদাশঙ্কায় তাহার সর্বশরীর কাঁপিয়া উঠিল । ' 
রাজকথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তাঁর , অথচ রাজার আচরণে কোনরুপ ছলনার প্রতিচ্ছবিও সে দেখেনি । 

এরপর দ্রুত পরিস্থতির রুপপরিবর্তন । গল্পে আসে এক নাটকীয় চমক । প্রধান পুরোহিত স্বয়ং পৌরুষের দম্ভে বলেন , 
পুরোহিত দেব প্রতিনিধি , সমুদয় দেব সম্পত্তিতে একমাত্র তাহারই অপ্রতিরোধ্য অধিকার । ' 
দেবপ্রতিনিধি হওয়ার সুবাদে , দেব উৎসর্গিত দাসীর উপরও তার অপ্রতিরোধ্য অধিকার । বিশোকার সাথে , সে যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারে , বলে সগর্ব ঘোষণা দেন । স্বপ্ন এবং বাস্তব বিশোকার কাছে ধরা দেয় দিনের আলোর প্রবল দীপ্তি নিয়ে । 

গল্পের শেষ অংশটি  বড্ড করুণ । আজন্ম যে বিশ্বাসে সে বেড়ে উঠেছে , তা সত্য নয় এই ভাবনা বিশোকার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে । সে দেবতার নয় , পুরোহিতের সেবিকা ।  রক্ষিতা । এটা মেনে নিতে পারে না  বিশোকা । তাই , পৃথিবীর সব নিয়ম প্রথার বাইরে নিজেকে বিলীন করে দেয় বিশোকা , যা পাঠক হৃদয়কেও ক্ষত বিক্ষত করে । গল্পটিতে লেখিকা ভারি চমৎকার ভঙ্গিমায় এই প্রথার অপদিকগুলো পাঠক দরকারে উপস্থাপন করেছেন । নারী জীবনের মর্মান্তিক পরিণতি , বিশোকা চম্পাদের নরক দর্শন যেন সভ্যতার কাছে , এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।