কোমরের ব্যথাকে একদম অবহেলা নয়। ডা. আবু তাহের ।
নোঙর আপডেট । |
সারাজীবনে একবারও কোমরের যন্ত্রনায় ভোগেন নি এমন মানুষ খুঁজলে বড় একটা পাওয়া যাবে না।শীতকালে এই সমস্যা আরও বেড়ে যায়।তাই প্রথমেই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ঠিক কী কারণে কোমরে ব্যথা করছে।কোমরে ব্যথা কারো কারো ক্ষেত্রে সামান্য আবার কারো বা অসহ্য যন্ত্রণা হয় , কখনো অল্প কিছুদিনের জন্য হয় আবার কখনো মাসের পর মাস এই যন্ত্রণার স্থায়িত্ব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অসহনীয় হয়ে ওঠে। কোমরের ব্যথাকে আমরা মেডিকেল পরিভাষায় Back Pain বলি।
সাধারণত যেসব কারণে কোমরের ব্যথা হতে পারে--
১.শরীরের অস্থি, অস্থিসন্ধি, অস্থিসন্ধির আবরণী, ডিস্ক কিংবা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো রোগ থাকলে কোমরে ব্যথা হতে পারে।
২.বুক, পেট এবং তলপেটের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নানারকম সমস্যা যেমন পিরিয়ডসের সমস্যা, ইউরিনারি ইনফেকশন, কিডনিতে পাথর,জরায়ুতে টিউমার ইত্যাদি কারণেও কোমর ব্যথা হতে পারে।
৩. কোমর ব্যথার অন্যতম একটি সাধারণ কারণ হল আমাদের বসার ত্রুটিপূর্ণ ভঙ্গি। যাঁরা অফিসে দীর্ঘক্ষণ একই ভঙ্গিতে বসে কাজ করেন তাদের ক্ষেত্রে কোমর ব্যথা অবধারিত।
৪. কোমর ব্যথার কারণ জানতে আমরা রোগীর কাছে অবশ্যই সুদূর অতীতে বা বর্তমানে কোনো চোটের (Trauma) ইতিহাস আছে কিনা জানতে চাই।
৫.দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালানোর সময়েও হতে পারে কোমরের ব্যথার মত সমস্যা।তাই গাড়ি চালানোর সময় কোমরে কোনো কিছুর সাপোর্ট দিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
৬.নীচু হয়ে ঝুঁকে কোনো ভারি জিনিস তোলার সময়ে শরীরে কখনো কখনো হ্যাঁচকা টান অনুভূত হয়। ঝুঁকে কাজ করার সময় আমাদের শরীরের পজিশন ঠিক থাকে না। এমতাবস্থায় ভারি জিনিস তুলতে গিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে শরীরের সমস্ত ভার চালিত হয়।ফলে একটি অসাম্যের সৃষ্টি হয় আমাদের শরীরে।যে কারণে কোমরে চোট লেগে ব্যথার সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো সামান্য বিরতি নেওয়ার পরে কয়েকদিনের মধ্যেই এই ব্যথা উপশম হয়। কিন্তু যদি দেখা যায় ব্যথা দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে,তার সাথে ব্লাডার ও বাওয়েলের অভ্যাসে সমস্যা হচ্ছে তাহলে দেরি না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কখনো কখনো কোমরের ব্যথা শিরদাঁড়া দিয়ে সোজা নেমে আসে পায়ের গোড়ালিতে। শরীরের নিচের অংশে স্নায়বিক শৈথিল্য দেখা যায়। অর্থাৎ শরীরের নিচের দিকে ক্রমাগত অবশ ভাব লক্ষ্য করা যায়। এমতাবস্থায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা--
১. ঠিক কী কারণে কোমরে ব্যথা হচ্ছে সেই বিষয়টি আগে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।তার জন্য কোমরের প্রয়োজনীয় এক্স রে, সি টি স্ক্যান,এম আর আই ইত্যাদি পরীক্ষা করানোর দরকার পড়ে। যদি দেখা যায় মহিলাদের ক্ষেত্রে পিরিয়ডসের সমস্যার জন্য কিংবা জরায়ুর টিউমারের কারণে কোমরে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে তাহলে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। প্রয়োজনে শল্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তাছাড়া মহিলাদের ক্ষেত্রে আলাদা করে ইউরিনারি ইনফেকশনের সম্ভাবনা বেশি, সে জন্য সঠিকভাবে মূত্র সংক্রমণের চিকিৎসা করতে হবে।
২.স্পনডাইলোসিসের সমস্যা হলে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে ফিজিওথেরাপি করাতে হবে নিয়মিত। সামনের দিকে ঝুঁকে কাজ করা বন্ধ করতে হবে।মনে রাখতে ছোট বড় চোটের কারণে কোমরে ব্যথা উপশম হতে পারে কেবলমাত্র বিশ্রামের মাধ্যমে ।তাই শরীরকে আবার চাঙ্গা করে তুলতে চাইলে একটু ক্ষতিপূরণ তো করতেই হবে। যদিও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষকে কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা আয় করতে হয় তবুও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা ভেবে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম নিতেই হবে।
৩. অযথা ব্যথার ওষুধ না খেয়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ধারণের উপর আমরা বেশি জোর দিই। কোমরে ব্যথার ক্ষেত্রে একটি বিষয় আমাদের বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হয়: আমাদের স্পাইনাল প্রসেসের চলাচল যেন ঠিক থাকে। না হলে কিন্তু ব্যথা উপশম হলেও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়বে আমাদের শরীর। তাই ব্যথা উপশমের সাথে সাথে মুভমেন্টের দিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
৫.নিজে নিজে কখনো ডাক্তারি করতে যাবেন না।চোট লাগার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে ইন্টারনেট থেকে পড়ে কিংবা ইউটিউব দেখে ব্যায়াম করতে যাওয়ার ফলে হিতে বিপরীত হয়। তাই একবার ডাক্তারের পরামর্শ মত ফিজিওথেরাপি শুরু করুন।গ্রামে গঞ্জে আমরা প্রায় দেখি অনেক হাতুড়ে হাড়ের চিকিৎসা করে থাকেন। তাদের কিছু প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান হয়তো আছে কিন্তু পড়াশোনার জ্ঞান না থাকায় সামান্য সমস্যা পরবর্তীতে বড় আকার ধারণ করতে পারে।এই সমস্ত সতর্কতাগুলো অবলম্বন করলে ভবিষ্যতে ভোগান্তিতে পড়তে হবে না আশা করি।
৫.চোট লাগার ক্ষেত্রে প্রথম দুই থেকে তিন দিন ঠাণ্ডা বরফ লাগাতে পারেন।তার পরে অবশ্য ঠান্ডা ও গরম জলের সংমিশ্রণে মালিশ করতে পারেন।
৬.বিনা প্রেসক্রিপশনে কখনোই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ কিনে খাবেন না। প্রথম দিকে আমরা অবশ্য স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারে উৎসাহিত করিনা। এক্ষেত্রে নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ওষুধ ব্যবহার করে ব্যথা কমিয়ে অবশ্য ব্যায়াম করা ভালো। ব্যথা অবস্থায় ব্যায়াম না করে ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমিয়ে ফিজিওথেরাপি করবেন।
পরিশেষে বলি কোমরের ব্যথাকে অবহেলা করবেন না। ব্যথা চেপে রেখে বাকি জীবনটা ব্যথায় জর্জরিত করবেন না। উপযুক্ত চিকিৎসা এবং সার্জারির মাধ্যমে কিন্তু শরীরের কঠিন কঠিন কোমরের যন্ত্রনার নিরাময়ও সম্ভবপর হয়।সবার সুস্থ সুন্দর জীবনের শুভকামনা করি।
আবু তাহের।
ভগবানগোলা।মুর্শিদাবাদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন