বহুমূত্র রোগ থেকে বাঁচুন । ডা : আবু তাহের ।
চিকিৎসক জিয়াগঞ্জ গ্রামীণ হসপিটাল ।
বহুমূত্র বা 'ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস' হলো রোগের এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে জল বেরিয়ে যায়। অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায় সাধারণত মূত্রের মাধ্যমে।বারেবারে মূত্র ত্যাগের ইচ্ছে জন্মায় এবং একাধিকবার মূত্র ত্যাগের ফলে শরীরে একদিকে যেমন জলের ঘাটতি দেখা যায় তেমনি জলের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ধরনের বিপাক প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়।এই সমস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এদের অতিরিক্ত জলপানের ইচ্ছা থাকে সবসময়। আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশে খাদ্যগ্রহণের ইচ্ছা কেন্দ্র থাকে।এই বহুমূত্র রোগীদের আবার খাদ্য গ্রহণের প্রবল ইচ্ছে থাকে। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ যায় বেড়ে। সেখান থেকে আবার ডায়াবেটিসের যে সমস্ত লক্ষণ সেগুলো প্রকটভাবে দেখা যায় এদের ক্ষেত্রে।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় সাদৃশ্য থাকলেও বহুমূত্র রোগের কারণ হিসেবে দুটো প্রধান দিকের কথাই উল্লেখ করা যায়।এক, কিডনি জনিত সমস্যা থেকে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ। এবং মস্তিষ্কের বা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতায় গোলযোগের কারণে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ।
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতায় বাঁধা পড়ে যখন আমাদের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ভ্যাসোপ্রেসিন নামের একটি হরমোনের ক্ষরণে গণ্ডগোল হয়।ভ্যাসোপ্রেসিনের কম ক্ষরণের কারণে বহুমূত্র রোগ দেখা দেয়।এই "ভ্যাসোপ্রেসিন" আমাদের শরীরে ফ্লুইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। আবার আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের পিটুইটারি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ভ্যাসোপ্রেসিন ক্ষরিত হচ্ছে কিন্তু কিডনি তে এসে ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। কিডনির জন্মগত কোনো রোগ বা কিডনির অন্যান্য অসুখের কারণে এমনটি হতে পারে।একে বলে "নেফ্রোজেনিক ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস" অর্থাৎ কিডনি থেকে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ।
বহুমূত্র এমন একটি রোগের অবস্থা যেখানে শরীর তার জলের ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায় মূত্রের মাধ্যমে।আর আমরা সকলেই মূত্রের মাধ্যমে কেবলমাত্র যে জল বেরিয়ে যায় বলা হচ্ছে তাতে কিন্তু শুধু জল থাকে না। থাকে নানারকম খনিজ লবণ ও।ফলে অতিরিক্ত খনিজ লবণ যখন শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তখন শারীরিক দূর্বলতা, মানসিক অবসাদ, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ গুলো দেখা যায়।
বহুমূত্র রোগ যেহেতু খুব সাধারণ নয় তাই এই রোগ নির্ণয় করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।তাই অন্যান্য রোগের যে সমস্ত সাধারণ লক্ষণ গুলো রয়েছে তার থেকে একে আলাদা করে ফেলা উচিত।মনে রাখা উচিত এই রোগের প্রাথমিক এবং অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো অতিরিক্ত পরিমাণে লঘু মূত্র ত্যাগ করা।তার সাথে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে জল তেষ্টা পাওয়া। এক্ষেত্রে একটি মজার জিনিস লক্ষ্য করা যায়। রোগীর যেহেতু অতিরিক্ত পরিমাণে মূত্র ত্যাগের আশঙ্কা থাকে তাই জল তেষ্টা পেলেও রোগী জল পান করতে চায় না।
রাতের বেলা নিঃসাড়ে মূত্র ত্যাগ, বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মূত্র নির্গত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখেও চেনা যায় এই রোগ।
আরেকটি গৌণ লক্ষণ হিসেবে শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়।ফলে ডিহাইড্রেশনের ফলে রোগীর প্রচণ্ড শারীরিক অবনতি দেখা যায়।বিশেষভাবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষতিকারক প্রভাব মারাত্মক। কেননা বাচ্চারা তাদের শরীরে জল তেষ্টার কথা জানাতে অপারগ।ফলে অনেক সময় সময় ডায়রিয়া বমি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শারীরিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হতে দেখা যায়।
অতিরিক্ত জলের ঘাটতির ফলে রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ এত বেড়ে যায় যে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সোডিয়াম আমাদের শরীরের একটি অন্যতম প্রধান খনিজ লবণ। এক্ষেত্রে সোডিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হলো দেহ থেকে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়া।
সোডিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি অর্থাৎ হাইপার-নেট্রেমিয়ার ফলে স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরুপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মস্তিষ্কের কাজের ব্যাঘাত ঘটে, রোগী ভুল বকে এবং কোমাতেও চলে যেতে দেখা যায় কখনো কখনো রোগীকে।
চিকিৎসা ছাড়া কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কারণে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ কিডনির উপরেও প্রভাব ফেলে।হয়ে যেতে পারে কিডনি বিকল। কিডনি বিকল হয়ে পড়লে তখন সমস্ত অঙ্গকেও আস্তে আস্তে আক্রমণ করতে শুরু করে।ফলে মাল্টি অরগ্যান-ফেলিওর হয়ে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
এবার আসা যাক চিকিৎসার সাধারণ বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনাই।যে সমস্ত রোগী নিজের শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম তাদের ক্ষেত্রে বহুমূত্র রোগ বিশেষ ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যারা এই কাজে অক্ষম তাদের অতিরিক্ত নজরদারিতে রাখা উচিত।শরীরে জল এবং অন্যান্য খনিজ লবণের মাত্রা ঠিকঠাক থাকলে বহুমূত্র রোগ কিডনির উপরেও কোনো আঘাত হানতে পারে না।
এক্ষেত্রে যদি দেখা যায় বহুমূত্র অবস্থা যে রোগের কারণে হচ্ছে সেই রোগকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রোগীর এই সমস্যা থেকে সুরাহা মেলে।যেমন ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের কারণে যে বহুমূত্র রোগ দেখা দেয় তা ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার মাধ্যমে বন্ধ করা সম্ভব।কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও হতে পারে বহুমূত্র জনিত সমস্যা। ওষুধ শনাক্ত করে অন্য সারির ওষুধ প্রয়োগ জরুরি এইসমস্ত ক্ষেত্রে।
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের এবং গর্ভাবস্থায় বহুমূত্র রোগের ক্ষেত্রে ভ্যাসোপ্রেসিন হরমোনের পরিপূরক একটি হরমোন ওষুধের মাধ্যমে যোগান দেওয়া হয়।এর নাম ডেসমোপ্রেসিন।এই ওষুধ টি নাকের স্প্রে হিসেবে, মুখে খাওয়া ট্যাবলেট হিসেবে অথবা ইনজেকশনের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে।
রোগীর যত্ন নেওয়া প্রয়োজন কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে জলের ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে যেন শরীরে জলের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি না পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওভার-হাইড্রেসনের ফলে দেহে সোডিয়ামের ঘাটতি এবং জলের আধিক্য জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।তাই এ বিষয়টি নজরে রাখা দরকার।
ডেসমোপ্রেসিন নামের এই হরমোন পরিপূরক টি শরীরে বিশেষ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই কাজ করে।তবে বিকল হয়ে যাওয়া কিডনির ক্ষেত্রে এর কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায় না।
বহুমূত্র রোগীদের ক্ষেত্রে খাদ্যগ্রহণের একটা বিশেষ তালিকা রাখতে হয়। কখনো প্রয়োজন হলে একজন খাদ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সাধারণত তেল ,ঝাল,মশলা জাতীয় খাবার গ্রহণে বাধা রয়েছে। খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করা উচিত নয়। এমনকি লবণের পরিমাণ দিনে পাঁচ গ্রামের কমে নিয়ে আসতে পারলে উপকার হয়। ফাস্ট ফুড,জাঙ্ক ফুড,প্রসেসড ফুড ইত্যাদি যে সমস্ত খাদ্য আজকাল বাজারে পাওয়া যায় কিডনির উপর সেগুলোর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। অতিরিক্ত তেল ঝাল মশলা বিহীন সহজপাচ্য খাবারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
বহুমূত্র রোগের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের হাতের বাইরে। যেহেতু বহুমূত্র রোগের একটা বড় অংশ জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে তাই নিরাময় হয়তো আমাদের হাতে রয়েছে কিন্তু প্রিভেনশন হাতে নেই।তবে কিডনি ও মস্তিষ্কের যে সমস্ত কারণে বহুমূত্র রোগ দেখা দেয় তাদের নিয়ন্ত্রণ আগে থেকে কিছুটা করা যেতে পারে সচেতন থাকলে।
মনে রাখতে হবে মধুমেহ বা ডায়াবেটিস মেলাইটাস কিন্তু ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস অর্থাৎ বহুমূত্রের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে দেখা যায়। বহুমূত্রের সঙ্গে মধুমেহ'র একটা সম্পর্ক রয়েছে আর তা হল মধুমেহ রোগের ক্ষতিকর প্রভাব গুলোর একটি হল ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস অর্থাৎ বহুমূত্র। তাহলে বহুমূত্রের একটি কারণ যে মধুমেহ তা পরিষ্কার। আবার বহুমূত্রের অন্য নানান কারণ রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে মধুমেহ'র সম্পর্ক থাকতে পারে আবার নাও পারে।সে বিষয়ে উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
মধুমেহ রোগের ক্ষেত্রে রক্তের অতিরিক্ত শর্করা মূত্র উৎপাদনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা শরীর চায় মূত্রের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত শর্করা বের করে দিতে।ফলে মধুমেহ যদি কারণ হয় তবে তার একটি ফলের নাম বহুমূত্র।
বহু আগে যখন রোগ নির্ণয়ের নানারকম যন্ত্রপাতি এবং পরীক্ষা পদ্ধতি ওঠেনি তখন মূত্রের ঘনত্ব দেখে আন্দাজ করা হত মধুমেহ নাকি বহুমূত্র। এক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো যে,ইনসিপিডাস শব্দটির অর্থ লঘু অথবা স্বাদহীন।আবার মেলাইটাস এর অর্থ স্বাদ যুক্ত।এখন এই বিষয়টি পরিষ্কার যে মূত্রে শর্করা উপস্থিত থাকলে তা স্বাভাবিক ভাবেই ঘন এবং স্বাদযুক্ত হবে যা ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা মধুমেহ। এবং মূত্রে যদি অতিরিক্ত জল থাকে তাহলে তা লঘু এবং স্বাদহীন হবে যা বহুমূত্র রোগের লক্ষণ।তবে বহুমূত্র রোগ বিশুদ্ধ ভাবে মধুমেহ থেকে উৎপন্ন কিনা তা জানতে আগে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। কিন্তু বর্তমানে রোগ নির্ণয়ের আরও নানা আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে যা সহজেই এই দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে।
আর রোগের কারণ অনুযায়ী পাল্টে যায় চিকিৎসার ধরন।
বহুমূত্র বা 'ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস' হলো রোগের এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীর থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে জল বেরিয়ে যায়। অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায় সাধারণত মূত্রের মাধ্যমে।বারেবারে মূত্র ত্যাগের ইচ্ছে জন্মায় এবং একাধিকবার মূত্র ত্যাগের ফলে শরীরে একদিকে যেমন জলের ঘাটতি দেখা যায় তেমনি জলের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ধরনের বিপাক প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়।এই সমস্ত রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এদের অতিরিক্ত জলপানের ইচ্ছা থাকে সবসময়। আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশে খাদ্যগ্রহণের ইচ্ছা কেন্দ্র থাকে।এই বহুমূত্র রোগীদের আবার খাদ্য গ্রহণের প্রবল ইচ্ছে থাকে। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ যায় বেড়ে। সেখান থেকে আবার ডায়াবেটিসের যে সমস্ত লক্ষণ সেগুলো প্রকটভাবে দেখা যায় এদের ক্ষেত্রে।
ডায়াবেটিসের সঙ্গে কিছু কিছু জায়গায় সাদৃশ্য থাকলেও বহুমূত্র রোগের কারণ হিসেবে দুটো প্রধান দিকের কথাই উল্লেখ করা যায়।এক, কিডনি জনিত সমস্যা থেকে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ। এবং মস্তিষ্কের বা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতায় গোলযোগের কারণে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ।
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতায় বাঁধা পড়ে যখন আমাদের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ভ্যাসোপ্রেসিন নামের একটি হরমোনের ক্ষরণে গণ্ডগোল হয়।ভ্যাসোপ্রেসিনের কম ক্ষরণের কারণে বহুমূত্র রোগ দেখা দেয়।এই "ভ্যাসোপ্রেসিন" আমাদের শরীরে ফ্লুইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। আবার আরেকটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের পিটুইটারি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে ভ্যাসোপ্রেসিন ক্ষরিত হচ্ছে কিন্তু কিডনি তে এসে ঠিকমত কাজ করতে পারছে না। কিডনির জন্মগত কোনো রোগ বা কিডনির অন্যান্য অসুখের কারণে এমনটি হতে পারে।একে বলে "নেফ্রোজেনিক ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস" অর্থাৎ কিডনি থেকে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ।
বহুমূত্র এমন একটি রোগের অবস্থা যেখানে শরীর তার জলের ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যায় মূত্রের মাধ্যমে।আর আমরা সকলেই মূত্রের মাধ্যমে কেবলমাত্র যে জল বেরিয়ে যায় বলা হচ্ছে তাতে কিন্তু শুধু জল থাকে না। থাকে নানারকম খনিজ লবণ ও।ফলে অতিরিক্ত খনিজ লবণ যখন শরীর থেকে বেরিয়ে যায় তখন শারীরিক দূর্বলতা, মানসিক অবসাদ, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ গুলো দেখা যায়।
বহুমূত্র রোগ যেহেতু খুব সাধারণ নয় তাই এই রোগ নির্ণয় করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।তাই অন্যান্য রোগের যে সমস্ত সাধারণ লক্ষণ গুলো রয়েছে তার থেকে একে আলাদা করে ফেলা উচিত।মনে রাখা উচিত এই রোগের প্রাথমিক এবং অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো অতিরিক্ত পরিমাণে লঘু মূত্র ত্যাগ করা।তার সাথে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে জল তেষ্টা পাওয়া। এক্ষেত্রে একটি মজার জিনিস লক্ষ্য করা যায়। রোগীর যেহেতু অতিরিক্ত পরিমাণে মূত্র ত্যাগের আশঙ্কা থাকে তাই জল তেষ্টা পেলেও রোগী জল পান করতে চায় না।
রাতের বেলা নিঃসাড়ে মূত্র ত্যাগ, বিছানা ভিজিয়ে ফেলা, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মূত্র নির্গত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখেও চেনা যায় এই রোগ।
আরেকটি গৌণ লক্ষণ হিসেবে শরীরে জলের ঘাটতি দেখা দেয়।ফলে ডিহাইড্রেশনের ফলে রোগীর প্রচণ্ড শারীরিক অবনতি দেখা যায়।বিশেষভাবে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষতিকারক প্রভাব মারাত্মক। কেননা বাচ্চারা তাদের শরীরে জল তেষ্টার কথা জানাতে অপারগ।ফলে অনেক সময় সময় ডায়রিয়া বমি ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে শারীরিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হতে দেখা যায়।
অতিরিক্ত জলের ঘাটতির ফলে রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ এত বেড়ে যায় যে তা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সোডিয়াম আমাদের শরীরের একটি অন্যতম প্রধান খনিজ লবণ। এক্ষেত্রে সোডিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হলো দেহ থেকে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়া।
সোডিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি অর্থাৎ হাইপার-নেট্রেমিয়ার ফলে স্নায়ুতন্ত্রের উপর বিরুপ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মস্তিষ্কের কাজের ব্যাঘাত ঘটে, রোগী ভুল বকে এবং কোমাতেও চলে যেতে দেখা যায় কখনো কখনো রোগীকে।
চিকিৎসা ছাড়া কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কারণে উদ্ভূত বহুমূত্র রোগ কিডনির উপরেও প্রভাব ফেলে।হয়ে যেতে পারে কিডনি বিকল। কিডনি বিকল হয়ে পড়লে তখন সমস্ত অঙ্গকেও আস্তে আস্তে আক্রমণ করতে শুরু করে।ফলে মাল্টি অরগ্যান-ফেলিওর হয়ে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।
এবার আসা যাক চিকিৎসার সাধারণ বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনাই।যে সমস্ত রোগী নিজের শরীরে জলের ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম তাদের ক্ষেত্রে বহুমূত্র রোগ বিশেষ ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যারা এই কাজে অক্ষম তাদের অতিরিক্ত নজরদারিতে রাখা উচিত।শরীরে জল এবং অন্যান্য খনিজ লবণের মাত্রা ঠিকঠাক থাকলে বহুমূত্র রোগ কিডনির উপরেও কোনো আঘাত হানতে পারে না।
এক্ষেত্রে যদি দেখা যায় বহুমূত্র অবস্থা যে রোগের কারণে হচ্ছে সেই রোগকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রোগীর এই সমস্যা থেকে সুরাহা মেলে।যেমন ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের কারণে যে বহুমূত্র রোগ দেখা দেয় তা ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার মাধ্যমে বন্ধ করা সম্ভব।কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলেও হতে পারে বহুমূত্র জনিত সমস্যা। ওষুধ শনাক্ত করে অন্য সারির ওষুধ প্রয়োগ জরুরি এইসমস্ত ক্ষেত্রে।
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের এবং গর্ভাবস্থায় বহুমূত্র রোগের ক্ষেত্রে ভ্যাসোপ্রেসিন হরমোনের পরিপূরক একটি হরমোন ওষুধের মাধ্যমে যোগান দেওয়া হয়।এর নাম ডেসমোপ্রেসিন।এই ওষুধ টি নাকের স্প্রে হিসেবে, মুখে খাওয়া ট্যাবলেট হিসেবে অথবা ইনজেকশনের মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে।
রোগীর যত্ন নেওয়া প্রয়োজন কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে জলের ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে যেন শরীরে জলের মাত্রা অতিরিক্ত বৃদ্ধি না পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওভার-হাইড্রেসনের ফলে দেহে সোডিয়ামের ঘাটতি এবং জলের আধিক্য জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।তাই এ বিষয়টি নজরে রাখা দরকার।
ডেসমোপ্রেসিন নামের এই হরমোন পরিপূরক টি শরীরে বিশেষ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই কাজ করে।তবে বিকল হয়ে যাওয়া কিডনির ক্ষেত্রে এর কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায় না।
বহুমূত্র রোগীদের ক্ষেত্রে খাদ্যগ্রহণের একটা বিশেষ তালিকা রাখতে হয়। কখনো প্রয়োজন হলে একজন খাদ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সাধারণত তেল ,ঝাল,মশলা জাতীয় খাবার গ্রহণে বাধা রয়েছে। খাবারের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করা উচিত নয়। এমনকি লবণের পরিমাণ দিনে পাঁচ গ্রামের কমে নিয়ে আসতে পারলে উপকার হয়। ফাস্ট ফুড,জাঙ্ক ফুড,প্রসেসড ফুড ইত্যাদি যে সমস্ত খাদ্য আজকাল বাজারে পাওয়া যায় কিডনির উপর সেগুলোর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। অতিরিক্ত তেল ঝাল মশলা বিহীন সহজপাচ্য খাবারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
বহুমূত্র রোগের নিয়ন্ত্রণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের হাতের বাইরে। যেহেতু বহুমূত্র রোগের একটা বড় অংশ জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে তাই নিরাময় হয়তো আমাদের হাতে রয়েছে কিন্তু প্রিভেনশন হাতে নেই।তবে কিডনি ও মস্তিষ্কের যে সমস্ত কারণে বহুমূত্র রোগ দেখা দেয় তাদের নিয়ন্ত্রণ আগে থেকে কিছুটা করা যেতে পারে সচেতন থাকলে।
মনে রাখতে হবে মধুমেহ বা ডায়াবেটিস মেলাইটাস কিন্তু ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস অর্থাৎ বহুমূত্রের চেয়ে অনেক বেশি ঘটতে দেখা যায়। বহুমূত্রের সঙ্গে মধুমেহ'র একটা সম্পর্ক রয়েছে আর তা হল মধুমেহ রোগের ক্ষতিকর প্রভাব গুলোর একটি হল ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস অর্থাৎ বহুমূত্র। তাহলে বহুমূত্রের একটি কারণ যে মধুমেহ তা পরিষ্কার। আবার বহুমূত্রের অন্য নানান কারণ রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে মধুমেহ'র সম্পর্ক থাকতে পারে আবার নাও পারে।সে বিষয়ে উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
মধুমেহ রোগের ক্ষেত্রে রক্তের অতিরিক্ত শর্করা মূত্র উৎপাদনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা শরীর চায় মূত্রের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত শর্করা বের করে দিতে।ফলে মধুমেহ যদি কারণ হয় তবে তার একটি ফলের নাম বহুমূত্র।
বহু আগে যখন রোগ নির্ণয়ের নানারকম যন্ত্রপাতি এবং পরীক্ষা পদ্ধতি ওঠেনি তখন মূত্রের ঘনত্ব দেখে আন্দাজ করা হত মধুমেহ নাকি বহুমূত্র। এক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো যে,ইনসিপিডাস শব্দটির অর্থ লঘু অথবা স্বাদহীন।আবার মেলাইটাস এর অর্থ স্বাদ যুক্ত।এখন এই বিষয়টি পরিষ্কার যে মূত্রে শর্করা উপস্থিত থাকলে তা স্বাভাবিক ভাবেই ঘন এবং স্বাদযুক্ত হবে যা ডায়াবেটিস মেলাইটাস বা মধুমেহ। এবং মূত্রে যদি অতিরিক্ত জল থাকে তাহলে তা লঘু এবং স্বাদহীন হবে যা বহুমূত্র রোগের লক্ষণ।তবে বহুমূত্র রোগ বিশুদ্ধ ভাবে মধুমেহ থেকে উৎপন্ন কিনা তা জানতে আগে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হত। কিন্তু বর্তমানে রোগ নির্ণয়ের আরও নানা আধুনিক পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে যা সহজেই এই দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে।
আর রোগের কারণ অনুযায়ী পাল্টে যায় চিকিৎসার ধরন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন